Oct 23, 2018

অসাধারণ ভালোবাসার গল্প না পড়লে চরম মিস

তারপর একদিন আমি জানতে পারলাম , শায়নের স্ত্রী তার জীবনে আবার ফিরে আসতে চায় – শায়নকে ভুলে থাকাটা তার জন্য হয়ত অসম্ভব হয়ে যাচ্ছিল । আর ঠিক সেই মুহুর্তে আমার প্রচন্ড স্বার্থপর হয়ে যেতে ইচ্ছে করল – আমার ইচ্ছে করল শায়নকে নিজের কাছে রেখে দিতে । কিন্তু তার আগেই আমি অনুভব করলাম , সেই সময়টা আমার আর নেই । আমি তাকে হারিয়ে ফেলছি – একটু একটু করে । যে মানুষটা আমার পাঁচ মিনিটের দেরিতে অধৈর্য হয়ে যেত , সে কিনা সারাদিন আমার সাথে কথা না বলে কাটিয়ে দিতে পারে ।

জানেন পাঠক , জীবনে সেই প্রথমবারের মত আমার প্রচন্ড ভয় করল । তাকে ভালবাসবার আগে আমার যে হৃদয়টা তার প্রেমে পড়বার একশ একটি কারন খুঁজে দিত, সে হারিয়ে যেতে থাকবার মুহুর্তে সেই হৃদয়টা একদম বোবা হয়ে গেল । সে আমাকে কখনো চায়নি , কোন দিন ভালবাসেনি – এরকম হাজারটা চিৎকারে আমার মনের সব কয়টা জানলার কাঁচ ভেঙ্গে পড়তে লাগল প্রত্যেকে মুহুর্তে । সেই ভাঙ্গা কাচের আঘাতে আমার দুই হাত তখন প্রচন্ড রকম রক্তাক্ত – অথচ শায়নের চোখ সেদিকে এলোনা । আমি বুঝে নিলাম , যে মানুষটি আমার আকাশে উষ্ণ রোদ হয়ে এসেছিল , তাকে আমার যেতে দিতে হবে – তাকে ছাড়াই আমার এই জন্মে একটা মেঘলা জীবন কাটাতে হবে ।

খুব অবুঝের মত কান্না পেত আমার । তার সাথে সারাদিনের একটা টেক্সট যখন একসময় সারা মাসে একটা টেক্সটে পরিনত হল , তখন আমি বুঝলাম তার জীবনে আমার প্রয়োজনটা আর অবশিষ্ট নেই । তার কাছে গিয়ে শেষবারের মত জানতে চাইলাম , “তুমি আমার কাছ থেকে সরে যাচ্ছ কেন ?” শায়ন উত্তর দিয়েছিল , “আমার আর ভাল লাগছেনা ইরা।“ আমার পুরো পৃথিবী ভেঙ্গে ফেলবার জন্য ওর এই একটা কথাই যথেষ্ট ছিল ।

শায়নের হাত ছেড়ে দেয়াটা আমার জন্য কতটা কঠিন ব্যাপার – ওর হাতটা না ছাড়লে আমি হয়ত সেটা কোনদিন জানতাম না । মাঝেমাঝে মনে হত , আমি বুঝি আর পারব না । ইচ্ছে করত , ওর কাছে গিয়ে বলি – আমাকে ভালবাসতে হবেনা , তুমি শুধু আমার পাশে থাকবে ? প্লিজ ?

কিন্তু প্রতিবার আমি নিজেকে আটকে রাখলাম । আমার চলে যাওয়াতে শায়নের জীবনে যদি স্বস্তি ফিরে আসে , আমি সেটা কেমন করে নষ্ট করতে পারি ?

প্রিয় পাঠক, আমি চাইলে অনেক অভিযোগই তুলতে পারতাম । ওকে গিয়ে বলতে পারতাম , কেন এমন করলে ? চলেই যদি যাবে , আমার মধ্যে এই অনুভূতি কেন তৈরি করলে ? মুছেই যদি ফেলবে , কেন বলেছিলে আমি না থাকলে তোমার কষ্ট হবে ? আমি রেগে থাকলে তোমার ঘুম হবে না – কেন বলেছিলে ? কেন , শায়ন ? সবটুকু কান্না নিজের কাছে টেনে নিয়ে এই পৃথিবীতে কেন আমাকে একা বাঁচতে হবে, বলতে পারো ?

কিন্তু পরে ভাবলাম , কি লাভ ? এসব প্রশ্নের উত্তরে আমার কি কিছু আসবে যাবে ? এসব প্রশ্নের উত্তর আমাকে কি একটু উষ্ণতা দেবে ? না !

আমি ঠিক করলাম , আমার সবটুকু কষ্টের দায়ভার আমি নিজেই নিব – সবটুকু নিয়ে আমি অনেক দূরে চলে যাব – যতটা দূরে চলে গেলে শায়নের কখনো আমার জন্য নিজেকে অপরাধী মনে হবেনা – ঠিক ততটা ।
তারপর মুহুর্তে মুহুর্তে আমার মনের ভেতরটা ডিসেম্বর মাসের মতই উষ্ণতা হারিয়ে ফেলল । আমি অনুভব করলাম , আয়নার সামনে দাঁড়ালেও আমার প্রতিবিম্বটা কিরকম যেন কুয়াশার মত ধোঁয়াটে হয়ে যায় । মাঝে মাঝে নিজেকে অসহ্য লাগত , আবার কখনো নিজের জন্য মায়াও হত ভীষণ । তাই অদৃশ্য একটা শামুকের খোলসে নিজেকে আটকে ফেললাম আমি ।

আমার ক্যাম্পাসে এশিয়ান মেয়েদের একটা কম্যুনিটি ছিল । দেশ ছাড়বার পর প্রথমবারের মত একদিন সেই কম্যুনিটির আয়োজন করা পার্টিতে উপস্থিত হলাম আমি । ১৫ জনের ছোট্ট একটা গ্রুপ । এই কথা ওই কথায় সবার গল্পগুলো সেই একই জায়গায় গিয়ে জমল – ভালবাসা কিংবা সম্পর্ক ।

সবার গল্পগুলোই ভীষণ সুন্দর । তাদের ভালবাসার মানুষরা তাদের চোখের আড়াল করতে পারেনা – এইরকম ব্যাপারগুলো বাস্তবতায় শুনতে ভাল লাগছিল । একদম প্রায় শেষের দিকে আমার গল্পটা জানতে চাওয়া হল । আমি একটা দম চেপে বললাম , “ এত সুন্দর গল্পগুলোর পর আমার ওয়ান সাইডেড ব্যাপারটা বলা কি ঠিক হবে ? হাসি পাচ্ছে, তবু বলি - আমি যাকে পছন্দ করতাম , তার সাথে আমার সম্পর্ক টা আসলে কি ছিল আমি জানিনা । কিন্তু সত্যটা হচ্ছে – সে আমাকে কোনদিন অন্য চোখে দেখেনি । But it’s fine ! মেনে নিয়েছি আমি । এখন এইতো – একা আছি , ভাল আছি ।“

আমার পাশের মেয়েটা দুঃখ দুঃখ গলায় বলল , “ ভুলে যাও - কিছু ছেলে শুধু টাইম পাস ই করতে চায় ।“

আমি জানিনা কেন, কিন্তু এই “ টাইম পাস” শব্দটা শুনবার পরেই আমি আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলাম না । আমার দুই চোখ বেয়ে পানি পড়তে লাগল । ব্যাপারটা এমন না যে , ওই মুহুর্তে আমি শায়নের কথা ভেবে কষ্ট পাচ্ছিলাম , কিন্তু এই শব্দটা শুনবার সাথেই আমার একটা কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল। আমি কোনভাবে “ এক্সকিউজ মি” বলে বেরিয়ে আসলাম ।

শায়নের সাথে পরিচয়ের আগে রিলেশানশিপ নিয়ে আমার যে একটা এলার্জি ছিল তা হল এই “ টাইম পাস” । আমি এই শব্দটিকে প্রচন্ড ঘৃণা করতাম । তাই শায়ন যখন খুব নিয়ম করে আমার খোঁজ খবর নিত , আমি ওকে একদিন বললাম,

“ শায়ন – টাইম পাস নামক ব্যাপারটায় আমার প্রচন্ড এলার্জি আছে , জানো ? তুমি যদি শুধু মাত্র টাইম পাসের জন্য আমার সাথে কথা বল , তাহলে আমি দুঃখিত । আমাদের বরং এখানেই থেমে যাওয়া ভাল ।“
শায়ন উত্তর দিয়েছিল , “ না ইরা – এসব টাইম পাস না । এসব টাইম পাস না ।“

বাইরে বেরিয়ে এসে আমি খুব অসহায়ের মত কাঁদতে লাগলাম । শায়ন, তোমার জন্য একা একা সাফার করার এই যুদ্ধটা – তার কারন শুধুই তোমার টাইম পাস ? এই টাইম পাস , এই মিথ্যে – তোমাকে কি খুব আনন্দ দিয়েছে ? যেই শব্দটিকে আমি সবচেয়ে ঘৃণা করতাম – তুমি কেন সেই শব্দটা দিয়েই আমার পৃথিবীকে শেষ করে গেলে ?

কিছুতেই যখন চোখের পানি থামাতে পারছিলাম না আমি – ঠিক তখনই টের পেলাম , কেউ একজন আমার পাশ থেকে বলছে,
“সবার কাছে নিজেকে এত কঠিন দেখিয়ে কি লাভ বল তো ? তুমি নিজেও জানো তুমি কতটা দুর্বল – তাইনা ?”
আমি তাকিয়ে দেখলাম – জিন্স আর ব্লু রঙের টপ্স পরা একটা মেয়ে ভ্রূ কুঁচকে আমাকে কথাগুলো বলছে ।
“ আমি মিয়ানা । তুমি বোধ হয় খেয়াল করোনি আমাকে – কিন্তু আমি তোমার কথাগুলো শুনছিলাম । I am sorry, but you sound so fake..”
আমি হেসে ফেলেছিলাম – “ আমি জানি ।“
“ না জানো না । ওইখানে সবার সুইট কোটেড স্টোরি শুনে আমি তো ভ্যাবাচ্যাকাই খেয়ে যাচ্ছিলাম । ঘুম পাচ্ছিল । মনে হচ্ছিল , এ কেমন জীবন – একাই ধোঁকা খেয়েছি নাকি ? তারপর তোমার গল্প শুনে জেগে উঠলাম ।“

আমি চোখ মুছে বললাম ,“ আমার কিন্তু কোন রিগ্রেট নেই । আমি চেষ্টা করেছিলাম – সত্যি বলতে , বেহায়ার মতই চেষ্টা করেছিলাম । কিন্তু হয়নি আর কি !”

“ ফেইক । এসব বলো না আমাকে , ওকে ? চেষ্টার পরেও যখন কাউকে থামানো যায়না – তখন অপমান লাগে । কিন্তু আমি আশা করি , তুমি আমার মত অপমান হও নি । আমার কি হয়েছিল জানো ?”

“কি ?”

“ টাইম পাস তো টাইম পাস ই । আমি যখন আমার ফিলিংস এর কথা জানিয়ে ফেললাম , সেই বেচারা টেক্সট পাঠাল , মিয়ানা , আমি বুঝছিনা কি রিপ্লাই দিব । এই মুহুর্তে ক্লাব ফুটবল দেখছি – খেলা নিয়ে ভাবছি ।“

আমি মেয়েটার কথা বলার ধরন শুনে ফিক করে হেসে ফেললাম –

“ হাসছো ? আমি নিজেও হাসতে হাসতে হেচকি উঠিয়ে ফেলেছিলাম জানো ? ব্যাপার হচ্ছে , আমার সাথে যে ও থাকবেনা আমি জানতাম । তবুও সেধে সেধে অপমান হলাম । আর এই অপমানের পরেও ছেলেটাকে ভুলে যাওয়া গেল না – সেটা আরেক ব্যর্থতা । তবে কয়েক মাস পরেই ও বিয়ে করে ফেলেছিল । খোঁজ নিয়ে দেখেছিলাম , তখনো কিছু একটা ক্লাব ফুটবল চলছিল । কিন্তু ওই আর কি - মেয়েটার ইম্পরট্যান্স ক্লাব ফুটবলের চেয়ে বেশি ছিল । “

আমি তাকিয়ে দেখি , তার বোকা বোকা হাসির আড়ালে দুই চোখে ঠিক আমার মত কুয়াশা । আমি বুঝতে পারলাম, আমাদের দুইজনের হৃদয়েই বিচ্ছিরি রকম ডিসেম্বর ।
মিয়ানা আপু আমার পাঁচ বছরের সিনিয়র ছিল । মুখের উপর সত্যি বলে ফেলার অসাধারন একটা গুন ছিল আপুর । আর সেই আপু কিনা মনের মাঝে গোপন ডিসেম্বর নিয়ে একটা সত্যি ডিসেম্বরে সত্যি সত্যি উধাও হয়ে গেল । প্রিয় পাঠক, সায়ানাইড কখনো মিথ্যে বলে না ।

আমার হাতের কফিমগটা বরফের মত ঠান্ডা হয়ে আছে । জানলা জুড়ে পরদা কাঁপানো অতিথি হাওয়া আর তার সাথে মোবাইলটা বেজে যাচ্ছে একটানা । আমি চোখের পানি থামানোর বিন্দুমাত্র চেষ্টা না করে বললাম,

“ প্রিয় অতিথি হাওয়া – যে একটা মানুষকে ঘৃণা করতে পারলে আমার জীবনটা সহজ হয়ে যেত , তাকে ঘৃণা করাটা আমার জন্য এতখানি কঠিন কেন ?”

কেউ উত্তর দিল না । আমি হাত বাড়িয়ে মোবাইলটা নিলাম – তারপর তাকে বন্ধ করে দিলাম অনির্দিষ্টকালের জন্য ।

শায়নের জীবন থেকে -
১। ছাদের ওপর জমানো বৃষ্টির পানিতে ডুবতে থাকা সূর্যটা যখন একটু একটু করে রঙ ছড়াচ্ছিল , আমি তখন একরাশ বিষণ্ণতা নিয়ে ইরার দিকে মুখ ফেরালাম । বরাবরের মতই মেয়েটা তার নিজের জগতে হারিয়ে আছে – অনেক্ষন ধরে চেষ্টা করছে ক্যামেরার ফোকাসে তার পছন্দের একটা দৃশ্যকে আটকে রাখবার জন্য । আমি ইরাকে বিরক্ত না করে আমার দুই আঙ্গুলে প্রায় শেষ হয়ে যাওয়া সিগারেটটার দিকে তাকিয়ে থাকি । তারপর সাতপাঁচ না ভেবেই তাকে ছুড়ে মারি সেই জমে থাকা বৃষ্টির পানিতে ।

পানির ছলাত করে ওঠা শব্দে ইরা একটু চমকে গেল । তারপর ক্যামেরা থেকে চোখ না সরিয়েই বলল,
“ এই সিগারেট খাওয়া জিনিসটা যে আমি দুই চোখে দেখতে পারিনা তুমি জানো ?”

“হ্যা একটু একটু জানি ।“

মেয়েটা ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ফেলে আমার দিকে তাকাল,

“ কিন্তু সিগারেটের সাথে তোমাকে এত মানায় কেন ,বলবে ? সিগারেট একটা বিশাল বিচ্ছিরি জিনিস !”

আমি হাসবার মত আওয়াজ করে বলি,
“ আমিও তো তাই– বিশাল বিচ্ছিরি জিনিস ।“

ইরা তার ক্যামেরাটাকে গুটিয়ে নিয়ে আমার পাশে এসে বসল । তারপর সেই আলো আধারী ছায়ায় আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,
“ তোমার মত বিশাল বিচ্ছিরি একটা জিনিসকে এত ভাল লাগে কেন আমার ?”

আমি ইরার প্রশ্নের কোন উত্তর না দিয়ে উঠে দাঁড়াই ।
“ সন্ধ্যা হয়ে এসেছে ইরা । চল, তোমাকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে আসি । “

“বাসায় যাবার জন্য আমার আবার তোমাকে দরকার হল কবে থেকে ?”

“ আচ্ছা” , বলেই সামনে পা বাড়াই আমি । দুই পা হাঁটতেই পেছন থেকে ইরার ডাক।

“ আরেকবার বলা যেত না শায়ন ? আমাকে বাসায় পৌঁছে দিতে ইচ্ছে করছে সেটা বললে কি হত ?”

“তুমি বুঝতে না পারলে বলতাম ।“
ইরা কোন উত্তর দিল না । আমি ওর উঠে আসবার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকলাম । তারপর পাঁচ মিনিট গেল , দশ মিনিট গেল – ইরা আর উঠে আসলো না । অধৈর্য হয়ে একটা সময় আমি পেছন ফিরে তাকাই - অবাক হয়ে আবিষ্কার করি , ইরা নেই – কোথাও নেই । সেই রঙ ছড়ানো সূর্য, ছাদে জমানো জল , ভাসতে থাকা আধ খাওয়া সিগারেট – সব একই রকম রয়েছে । শুধু ইরা নামের সেই ছটফটে মেয়েটি নেই - এই ছাদের ওপর আমার সাথে সে কখনোই বসে ছিল না ।

হঠাত করে আমার চোখের সামনে সবকিছু কেমন যেন ঝাপসা হয়ে যেতে লাগল । সেই ঝাপসা চোখে পাগলের মত এদিক ওদিক তাকিয়ে আমি ইরাকে খুঁজতে থাকি – আকুল হয়ে ডেকে বলি ,
“ইরা ! ইরা ! I am so sorry.. I am so sorry.. “

জ্ঞান হারিয়ে ফেলবার আগে আমি আমার কাঁধে একজনের হাতের স্পর্শ অনুভব করি । চোখ বন্ধ করবার পর আমি আমার সমস্ত হৃদয় দিয়ে প্রার্থনা করি সেই হাতদুটো যেন ইরার হয় । কিন্তু আমি জানি , সেটা অসম্ভব । কারন আমাকে আঁকড়ে ধরে পাথরের মত বসে থাকা মানুষটি আমার স্ত্রী – সাবা ।


EmoticonEmoticon