Nov 8, 2018

অসাধারন স্বামী ও স্ত্রীর ভালোবাসার গল্প পর্ব - ১১ (ইসলামিক জীবন)




পর্ব এগারো....
বেলা তিনটা করে মাকে সাথে নিয়ে গেলাম তালিমে।মাকে রাজি করাতে খুব একটা বেগ পেতে হয়নি অামার।যখন নির্দিষ্ট বাড়িতে পৌঁছালাম,অামার গলা শুকিয়ে যাচ্ছিলো,হার্টবিট বেড়ে যাচ্ছিলো,এক ধরণের অজানা অাতঙ্ক হচ্ছিলো।বরাবরই শুনে এসেছি এইসব তালিমে জাল,বানোয়াট,বিদঅাতি মাসঅালার শিক্ষা দেয়,তবুও ভরসা,শায়খ বলেছেন এই তালিম টা নির্ভরযোগ্য। পাশাপাশি তিন মেয়ে সহ মা অালিমা,অারেক মেয়ে মিশকাতে পড়ছে,বাবা মুয়াজ্জিন,গড়মিল থাকার কথা না।অাল্লাহর নাম নিয়ে দরজায় নক করলাম।পরপর তিনবার নক করতেই খুলে গেলো।অাপাদমস্তক ঢাকা একজন এসে সালাম দিয়ে মুসাফাহা করলেন,ভেতরে গিয়ে বসতেই দেখি প্রায় জনা ত্রিশেক নারী,বেশীরভাগ ই অামার বয়সী।এটা ভেবে ভালো লাগলো যে,তরুণ প্রজন্মের একটা অংশ এখনও অামার রব্বের হিদায়াহর ছায়ায় অাছে।অালহামদুলিল্লাহ,সুম্মা অালহামদুলিল্লাহ!!
নিকাবটা খুলবো কিনা তা নিয়ে একটু ইতস্তত করছিলাম।এগিয়ে এলেন সেই অান্টি টি।নিজের নিকাব খুলে অামায়ও নিকাব খুলতে বললেন।গ্লাসে করে পানি এগিয়ে দিলেন পরম অাদরে,মুখে প্রশস্ত এক হাসি,ঠিক অামার শায়খের মতন।এক মুহূর্ত ভাবলাম,যারা একটুখানি দ্বীনের পথে চলে,তাদের দেখলেই বুঝি মন ভরে যায়!অামার শায়খ,এই যে পঞ্চাশোর্ধ অান্টি,তালিমের বাকি মানুষগুলো।একরাশ মুগ্ধতা ছেয়ে রেখেছিলো অামায়।
সেদিনের অালোচ্য বিষয় ছিলো "নামাযের গুরুত্ব,স্বলাত অাদায়ে উদাসীনতা অার বে নামাযীর শাস্তি"।অামি অবাক হচ্ছিলাম অান্টির উপস্থাপনা দেখে।নামাযের গুরুত্ব বলতে বলতে তার চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠছিলো,বে নামাযীর শাস্তি বলার সময় হুহু করে কেঁদে উঠছিলেন তিনি।অাশপাশের সবার চোখ ভেজা,এমনকি অামার শাশুড়ি মায়েরও।ওই অান্টিটা যখন বলছিলেন,
"তোমরা কিছু করো না অার না করো,নামায অাদায় করো।সময় বয়ে যায়,কে কখন চলে যাব অামাদের অাসল বাড়িতে।তখন অামাদের ঝুলিতে একমাত্র অামল ছাড়া কিছু তো থাকবেনা।একমাত্র নামাযই অামাদেরকে হিসাব নিকাশের পর সাকারে যাওয়া থেকে দূরে রাখতে পারবে........."
অামি মন্ত্র মুগ্ধ হয়ে শুনছিলাম।তার বাচনভঙ্গি এমন ছিলো যে অামার অন্তর কেঁপে উঠছিলো।সম্বিৎ ফিরলো অাসরের অাজান শুরু হওয়ার সময়।একসাথে সবাই অাযানের উত্তর দিলাম।অাযান শেষে দুঅা করলাম।তারপর সবাই হাত তুলে মোনাজাতে দুঅা করলাম।মোনাজাতের পর সবাইকে দুটো করে খেঁজুর অার একগ্লাস ঠান্ডা পানি খেতে দেওয়া হলো।ফেরার সময় খেয়াল করলাম মা যিকর করছেন,বিভ্রান্তের মতন এদিক ওদিক তাকাচ্ছেন।সারা রাস্তা অামার সাথে কথা বলেন নি।ঘরে গিয়ে নামায পড়ে কাঁদলেন,অনেক কাঁদলেন।মনের ভেতর তখন কেমন অনুভূতি হচ্ছিলো বলে বোঝাতে পারবো না,এটাই ছিলো অামার উপর,অামার শাশুড়ি মায়ের উপর অামার রব্বে কারীমের নিয়ামত,
সুবহানআল্লাহ!অালহামদুলিল্লাহ!অাল্লাহু অাকবার!!!
যতই দিন যাচ্ছিলো,মা একটু একটু করে দ্বীনের পথে অাসছিলেন,বাসায় নামাযের সময়সূচীর চিরস্থায়ী ক্যালেন্ডার থাকা সত্ত্বেও মা একটু পরপর এসে জিজ্ঞেস করতেন,
"এই মেয়ে,দেখো তো তোমার মোবাইলে,নামাযের ওয়াক্ত হলো কিনা"।
অারও খেয়াল করলাম মা চাশতের,ইশরাকের নামাযও পড়ছেন। সালাতুত তাসবীহ অার তাহাজ্জুদ তো একদমই ছাড়ছেন না।ওয়াক্ত হওয়ার পরও অামি যদি একটু বিলম্ব করতাম নামায পড়তে,মা কড়া গলায় ধমকাতেন।বলতেন,
"কি হ্যাঁ?নামায পড়বে না নাকি?ফিরিশতাদেরকে বলিও না যে সংসারের কাজ সামলাতে গিয়ে নামায পড়তে পারোনি।অবশ্য বললেও লাভ হবে না।তাড়াতাড়ি যাও,নামায পড়ো।পরে হাজার অামল থাকলেও যদি এই নামাযের জন্য তোমাকে সাকারে যেতে হয়,তাহলে কিন্তু অামি বেহেশতের কোনও হুরপরির সাথে অামার ছেলের বিয়ে দিয়ে দিব।"
মায়ের ধমক শুনে অামি হাসতাম,দ্বীনের পথে প্রথম প্রথম এলে চল্লিশোর্ধ কেউ ও যে ছয় বছরের বাচ্চা মেয়ের মতন শিশু হয়ে যায়,তা অামি স্বচক্ষে এই প্রথমবারের মতন দেখলাম।মাঝেমাঝে উনার অামল করা দেখলে অামারই হিংসা হতো।প্রতিযোগীতা করে অামল শুরু করেছিলাম মায়ের সাথে।সেই অনুভূতিগুলো অন্যরকম,একদম অন্যরকম।হটাৎই একদিন তালিমে "স্ত্রীর অধিকার,স্ত্রীর কর্তব্য" নিয়ে অালোচনা হচ্ছিলো।তীব্রভাবে ঝাঁকি খেলাম যখন অান্টি বললেন,
"জাহেলিয়াত!জাহেলিয়াত!!এটা সম্পূর্ণ জাহেলিয়াত!দেওর ভাবির কাছে মৃত্যুর সমান হওয়া সত্ত্বেও মানুষ ভাবিকে দেওরের মায়ের সমান বলে তূলনা করে।দেওর ভাবির মাঝে কোনও পর্দা নেই,যা তা অবস্থা।তার উপর সমাজের একটা ধারণা হয়েছে বউ শ্বশুড়-শাশুড়ির সেবা করবে,একটু এদিক সেদিক হলে সংসারে অশান্তি থেকে শুরু করে তালাক পর্যন্ত হয়ে যাচ্ছে,যেন এটা ফরজ ওয়াজিব কিছু।অাহারে মায়েরা শুনুন,ছেলের বউ অাপনাদের জন্য যা কিছু করে,তা একপ্রকার সাদকাহ অার মানবিকতা।এটার জন্য ওরা কিন্তু বাধ্য না।অথচ সমাজের নীতি হলো এমন,শ্বশুড় শ্বাশুড়ির সেবা করবে ছেলের বউয়েরা,অার নিজের মা বাবা চুলোয়া যাক,তাতে কার কি"......"
অামি খেয়াল করলাম মা সবটুকু কথা যেন গোগ্রাসে গিলছেন।সারা পথ গম্ভীর ছিলেন।অামার শায়খের একটা স্বভাব হলো তিনি এসে অাগে মায়ের খোঁজ নেন।মায়ের জন্য এটা সেটা নিয়ে অাসেন।মায়ের হাই বিপি,পাশাপাশি ইদানিং মায়ের ডায়াবেটিস সহ অারও এই সেই অসুস্থতা দেখা দিচ্ছে।প্রতিদিন গিয়ে শায়খ চেক করে অাসেন মায়ের ওষুধ খাওয়া ঠিকঠাক হচ্ছে কিনা।সেদিন শায়খ অাসার অাধঘন্টা অাগ থেকেই মা ছটফট করছিলেন,বারবার ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছিলেন।শায়খ ফেরার পরপরই মা উনাকে জিজ্ঞেস করলেন,
--বেটা তুই তো ইসলাম নিয়ে পড়িস অনেক।তুই জানবি নিশ্চয়।শ্বশুড় শাশুড়ির সেবা করা নাকি ফরজ না?
--হ্যাঁ,না ই তো।হাদিসে রসূলুল্লাহ সল্লাল্লহু অালাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে অভিশাপ দিয়েছেন,যার জীবদ্দশায় মা-বাবা কিংবা কেবলমাত্র একজন বেঁচে থাকা সত্ত্বেও যে তাদের সেবা না করে জাহান্নামে যাবে।পাশাপাশি একবার এক লোক,রসূলুল্লাহর কাছে জিহাদে যাওয়ার অনুমতি চাইলে তিনি ওই ব্যাক্তিকে ঘরে গিয়ে নিজের বাবা মায়ের সেবা করতে বলেছেন।তুমি খেয়াল করো,একবারও কিন্তু শ্বশুড় শাশুড়ির কথা বলেন নি।অাসলে মা যার যার বাবা মায়ের খিদমাহ করার দায়িত্ব তার তার।
--তাহলে এই মেয়েটা অামার খিদমত করে কেন?
অামার দিকে ইঙ্গিত করে বললেন মা।
--অামিনা?ও তো তোমাকে ভালবেসে করে,বেশী বেশী নেকি কামাই করে জান্নাতে যাওয়ার জন্য করে।
--কিন্তু ও যদি ওর বাবা মায়ের খিদমত না করে,তাহলে ওর গুনাহ হবে না?
--উঁ,হতে পারে।
--তখন ফিরিশতারা কারণ জিজ্ঞেস করলে নিশ্চয় ও বলবে শাশুড়ির সেবা করতে গিয়ে বাবা মায়ের সেবা করতে পারেনি।
--হ্যাঁ,এটাও বলতে পারে।
--তাহলে শুন,একটা কাজ কর।টেবিল থেকে খাতাটা নে তো।অামি বলছি তুই লিখা শুরু কর।
১.প্রতি মাসে বাবা মায়ের কাছে বড়জোর দুইদিনের জন্য যেতে পারবে।অবশ্য অসুখ বা কোনও সমস্যা থাকলে অারও বেশিদিন বাবার বাড়িতে থাকতে পারে,সমস্যা নেই।
২.প্রতিদিন ফোনে বাবা মায়ের খোঁজখবর নিতে হবে।
৩.প্রতি মাসে তাকে নির্দিষ্ট কিছু টাকা দেওয়া হবে,সেটা দিয়ে বাবা মায়ের জন্য এটা সেটা হাদিয়া কিনে নিবে।
৪.বাবা মায়ের অসুস্থতার খবর শুনলে যত বড় সমস্যার মাঝেই থাকুক ও,বাবা মায়ের কাছে গিয়ে খিদমত করতে হবে।
৫.বাবা মাকে কখনও অসম্মান করে কিছু বলতে পারবেনা।
৬.প্রতিদিন তাদের জন্য দুঅা করতে হবে।
৭.উঁ....মনে পড়ছেনা অার।অাপাতত এগুলো থাক।এতটুকু লিখে নিচে লিখ "এসব শর্ত অামি সজ্ঞানে মেনে নিলাম।",তারপর নিচে ওর নাম লিখ,দুইপাশে সাক্ষীর নাম হিসেবে অামার অার তোর নাম লিখ।
লিখা হলে খাতাটা বাড়িয়ে দিয়ে মা অামার সাক্ষর নিলেন,শায়খের সাক্ষর নিলেন,নিজে সাক্ষর করলেন।তারপর খাতা হতে পৃষ্ঠাটা ছিঁড়ে ভাজ করতে করতে বললেন,
--শুনো মেয়ে,তুমি অাবার বলিও না অামার জন্য বাবা মায়ের খিদমত করতে পারো নি।হাশরের দিন কিন্তু তুমি অামাকে কোনওভাবে ফাঁসাতে পারবেনা।অাগে নিজের জান্নাত ঠিক করো যাও,বাবা মায়ের খিদমত করো অাগে,অামার খিদমত করার জন্য অামার পাঁচ ছেলেই কাফি।
মায়ের কাজকর্ম দেখে শায়খ মিটিমিটি হাসছেন,অামার চোখ ঝাপ্সা হয়ে অাসছিলো,মন চাচ্ছিলো গিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরে কিছুক্ষণ কাঁদি।কিন্তু কি একটা জড়তা কাজ করছিলো কে জানে,অামি অন্যদিকে তাকিয়ে ছিলাম।মা সালাম দিয়ে চলে গেলেন।অামি তখনও ধাতস্থ হতে পারছিলাম না।শায়খ পরম যত্নে অামায় কাছে টেনে নিলেন।থুতনীটা একটু উঁচু করে ধরে বললেন,
--তোমার চোখে হটাৎ হটাৎ পানি কেন অাসে অাহলিয়া?এখন তো তোমার খুশি হওয়া উচিৎ,এটা তো তোমারই প্রচেষ্টার ফল।তুমিই তো....
--না না!এটা অামার প্রচেষ্টার ফল না।বরং এটা তো অামার প্রতি অামার রব্বের করুণা,অালহামদুলিল্লাহ!
শায়খ জোড়ে চিৎকার দিয়ে বলে উঠলেন,
--অাল্লাহু অাকবার!অামিনা!তুমি জানোনা অামি কত সৌভাগ্যবান।অামার রব্ব শুধু অামায় চক্ষু শীতলকারী স্ত্রী ই দেননি,বরং অামার পরিবারে রহমত ঢেলে দিয়েছেন।মনে হয় একটুকরো জান্নাত দিয়েছেন অাল্লাহ তোমায় দেওয়ার মাধ্যমে।অালহামদুলিল্লাহ!!সুম্মা অালহামদুলিল্লাহ!
অামি লজ্জা পেয়ে উনার বুকে মুখ লুকালাম।উনি নন,বরং অামিই তো সৌভাগ্যবতী,যে কিনা এত পরহেজগার কাউকে জীবনসঙ্গী হিসেবে পেয়েছি।উনি অাচমকা বলে উঠলেন,
--এই অামিনা,উঠো তো,খিদা পেয়েছে অামার।অামি ভাত বাড়ি,তুমি গ্লাসে পানি ঢালো,দুটো খেঁজুর বের করে নাও।তাড়াতাড়ি করো।
অামি মৃদু হেসে উঠে পড়লাম,এটা তো সেই প্রথম দিন থেকেই রুটিন হয়ে গেছে।একদিন উনি ভাত বাড়বেন,অামি গ্লাসে পানি ঢেলে খেঁজুর নিয়ে অাসবো,অারেকদিন অামি ভাত বাড়বো,উনি গ্লাসে পানি ঢালা অার খেঁজুর নিয়ে অাসার কাজ করবেন।খাওয়া শেষে একদিন অামি প্লেট বাটি ধুবো,উনি বিছানা করবেন,অারেকদিন উনি ধোয়ার কাজ করবেন,অামি বিছানা করবো।এখন অামরা প্রায়ই একই প্লেটে খাই,একই গ্লাসের একই পাশে মুখ লাগিয়ে পানি খাই।রসূলুল্লাহকে অনুসরণ করার ক্ষেত্রে তিনি সবসময়ই এগিয়ে।
ইনশাঅাল্লাহ চলবে.....

5 comments

This comment has been removed by the author.

ইসলামিক লেখা অনলাইনে নেই বললেই চলে। কিছু কিছু ইসলামি ব্লগ আছে সেগুলো অনেক খুজাখুজির পর পাওয়া যায়। আপনার ব্লগটি অনেক উপকারি এবং আমি অনেক খুশি হয়েছি এমন একটি ব্লগ পেয়ে। আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ এমন একটি ব্লগ এবং লেখা আমাদের উপহার দেয়ার জন্য। ধন্যবাদ। বেঁচে থাকুক আপনার এই সুন্দর ব্লগটি।
শিক্ষণীয় ব্লগ

Vaii Next Part Gula koi?? Link dile or kuno source dile valo hoito. Big fan ❤️


EmoticonEmoticon