Nov 7, 2018

স্বামী ও স্ত্রীর ভালোবাসার গল্প পর্ব - ১০



পর্ব দশ.....
--বুঝলে অামিনা,এই তাজউইদ জিনিস টা কিন্তু খুবই মজার একটা বিষয়।প্রথমে দেখ,'মাখরাজ,সিফাতুল হুরুফ বা হারফের বৈশিষ্ট্য,নুন সাকিন,তানউইন,মিম সাকিন,উচ্চারণের পদ্ধতি,মাদ,ওয়াকফ,ইবতিদা'
মাত্র এই অল্প কয়টা পার্ট নিয়েই কিন্তু তাজউইদ গঠিত।কাজেই তাজউইদ শিখতে খুব একটা কষ্ট হবেনা ইনশাআল্লাহ!তাহলে শুরু করি?
--করুন।
--আরবী শুদ্ধ উচ্চারণের জন্য মাখরাজের গুরুত্বের শেষ নেই।মাখরাজ হলো অারবী শব্দগুলো উচ্চারণের স্থান।যেমন অামরা বাংলা বর্ণমালার সাতটি উচ্চারণ স্থল অাছে,তেমনই অারবী বর্ণমালার সতের টি উচ্চারণস্থান অাছে।
--বাংলা বর্ণমালারও উচ্চারণ স্থল অাছে!!!!
--হ্যাঁ,থাকবে না কেন?তুমিই দেখো না,"ম" বর্ণটা উচ্চারন করতে তোমায় যেমন দুই ঠোঁটের সাহায্য নেওয়া লাগে,"ক" বর্ণ উচ্চারণ করতেও কি দুই ঠোঁটের প্রয়োজন হয়?
--না,তা না।কিন্তু.......
অাচ্ছা সাতটা স্থান কি কি,একটু বলুন তো!
--বলতে গেলে তো দেরি হয়ে যাবে অামিনা।পরে বলবো নাহয়,অাগে মাখরাজ গুলো সম্পর্কে শুনো।
--না না,মাথায় একটা চিন্তা ঘুরছে।অাগে ওটা সমাধান করতে হবে।
--কি চিন্তা?কিসের সমাধান?
--অাসলে,অারবী বর্ণমালা সবগুলোই তো বাংলায় উচ্চারণ করা যায়।তাহলে বাংলা বর্ণমালা উচ্চারণের স্থান সাতটি,কিন্তু অারবী বর্ণমালা উচ্চারণের স্থান সতেরো টি...........
বিষয়টা কেমন এলোমেলো লাগছে না?যেমন ধরুন 'বা(ب)' এর কথা।বাংলায় ব এর সাথে অাকার যোগ করলেই তো অারবীতে বা(ب) উচ্চারিত হয়।অাবার ধরুন "হা(ح)" এর কথা,বাংলায় হ এর সাথে অাকার যোগ করলেই তো অারবীতে হা(ح) এর উচ্চারণ হবে।
অর্থাৎ অারবী সবগুলো হরফের উচ্চারণ তো বাংলা হরফের দ্বারা করা যায়,তাইনা?তাহলে বাকি দশটি অতিরিক্ত স্থানের কি দরকার উচ্চারণের জন্য?
--এটাই তো পয়েন্ট অামিনা।তুমি দেখো,অামি কিন্তু প্রতিবারই বলছি "তাজউইদ" কিন্তু বাংলায় পড়তে গেলে তুমি সবজায়গায় এই শব্দটাকে পাবে 'তাজবীদ' হিসেবে।এখন বলো,কোনটা সঠিক হওয়া উচিৎ?
--অবশ্যই তাজবীদ।
--না,তাজউইদ সঠিক হবে।কারণ অামরা ছোটবেলায় ওয়াও(وِ) যের 'বি(بِ)' শিখি,যেটার অাসল উচ্চারণ হবে ওয়াও(و) যের 'উই(وِ)'।
বুঝলে?পাশাপাশি দেখবে,অারবীতে দেখবে 'জিম(ج)-যাল(ذ)-যোয়া(ظ)-ঝা(ز)' শব্দগুলোকে অামরা 'জ' এর মতন করে উচ্চারণ করি।অর্থাৎ সবগুলোকে একই রকম করে উচ্চারণ করি।কিন্তু এদের উচ্চারণ অালাদা অালাদা।অামি একটু অাগেই তোমাকে দেখিয়েছি সামান্য একটুখানি উচ্চারণের জন্য অায়াতের অর্থ কিভাবে বদলে যায়,দেখিয়েছি না?
--হ্যাঁ,কিন্তু বাজারে যে বাংলায় অনুবাদ করা কুরঅান শরীফ গুলো পাওয়া যায়,ওখানেও তো এই হারফগুলোকে একইভাবে উচ্চারণ দেখায়।
--হ্যাঁ,ওটাই তো বলছি।তুমি পড়তে গেলে দেখবে জিমের(ج) উচ্চারণ এক রকম,যাল(ذ) এর উচ্চারণ অারেকরকম।যোয়ার(ظ) উচ্চারণ এক রকম,ঝার(ز)উচ্চারণ অারেক রকম।
কিন্তু বাংলায় খেয়াল করবে,এই হারফগুলোর উচ্চারণ বোঝানোর জন্য "জ" অার "য" ব্যবহৃত হয়।অাবার দেখো,ওয়াও(و) এর উচ্চারণের সমমানের কোনও বাংলা বর্ণ নেই বলে এটার উচ্চারণ বা(ب) এর মতন করা হয়।ক্বফের(ق) উচ্চারণ লিখার সময় যদিও ক এর নিচে ব হসন্ত দিয়ে বুঝিয়ে দেওয়া হয় এই উচ্চারণটা একটু ভিন্ন,তবুও অামরা সাধারণ মানুষ না বুঝে "কাফ(ك)" এর মত উচ্চারণ করে ফেলি।অথচ এই দুইটা হারফের উচ্চারণে বিস্তর পার্থক্য।এই একই অবস্থা তুমি দেখবে অন্যান্য অারবী সমজাতীয় হুরুফের মাঝেও।অাসলে বাংলা শব্দ ভাণ্ডার কানায় কানায় পূর্ণ হলেও অারবী হুরুফ উচ্চারণের সমান উচ্চারণ পূর্ণ বাংলা শব্দ খুব একটা বেশী নেই।এবার বুঝলে মাখরাজ সতেরো টি,কিন্তু বাংলা বর্ণমালার স্থান সাতটি হওয়ার কারণ?
--জ্বি বুঝলাম।কিন্তু হারফ অার অার হুরুফ কি?
--অারবী প্রতিটা বর্ণকে অালাদা অালাদা ভাবে বোঝালে তখন প্রতিটা অালাদা বর্ণকে হারফ বলে,বাংলায় যেটাকে অামরা হরফ বলি অারকি।অার হারফ হলো একের অধিক হরফের সমষ্টি।
--অর্থাৎ হারফ হলো বর্ণ,অার হুরুফ হলো বর্ণমালা,তাইতো?
--ঠিক তাই।এবার এসো সিফাতুল হুরুফ নিয়ে কথা বলি।সিফাত মানে তো জানো ই,গুণ বা বৈশিষ্ট্য।সিফাতুল হুরুফ হচ্ছে হারফগুলোর বৈশিষ্ট্য।এটা ভিন্ন ভিন্ন হারফের উচ্চারণ যাতে একই না হয়,সে দিকটা নিশ্চিত করে।তারপর দেখো,নুন সাকিন অার তানউইনে।
এর অাগে অামি তোমাকে হারকাতের সংজ্ঞা বলি কেমন?বাংলায় যেমন অা-কার(া),ই-কার(ি),দীর্ঘ-ই কার(ী) অাছে।তেমনই অারবী হারফ দ্বারা শব্দ গঠনের জন্য যবর,যের,পেশ অাছে।বাংলায় যদি তুমি বলো 'অম বংলদশ থক' তাহলে কি এটার কোনও অর্থ অাছে?নেই না!
কিন্তু তুমি যখন স্বরচিহ্ন যোগ করে বলবে,
'অামি বাংলাদেশে থাকি' তখন এটা কেবলমাত্র শব্দেই না,অাদর্শ একটি বাক্যেও পরিণত হয়।তেমনভাবেই অারবী বর্ণ 'অালিফ,লাম,হা,মিম,দাল,লাম,হা' একত্রিত করে 'الحمدله' বললে এটা কোনও বাক্য তো দূরে থাক,শব্দই হবে না।কিন্তু যখনই তুমি এই হারফগুলোতে যবর,যের,পেশ,সাকিন যু্ক্ত করবে,তখন এটি "অালহামদুলিল্লাহ" তে পরিণত হবে।যা কেবলমাত্র একটি শব্দ ই না।বরং একটি সফল বাক্যও বটে।এখন দেখো,এক যবর,এক যের অার এক পেশ কে হারকাত বলে।বুঝলে?
অার সাকিন মানে তো জানো ই,জযম।নুন সাকিন মানে হলো সাকিনযুক্ত নুন,বা এমন নুন,যেই নুনে হারকাত নেই।অার তানউইন হলো দুই যবর,দুই যের,এবং দুই পেশ বুঝলে?
--বুঝলাম,তারপর?
--তারপর হলো মিম সাকিন।মিম সাকিনও নুন সাকিনের অনুরূপ। অর্থাৎ সাকিনযুক্ত মিমকেই মিম সাকিন বলে।
এরপর হলো মাদ।মাদ অর্থ টেনে পড়া।একটু অাগে বললাম না,'লা ইলাহা ইল্লাল্লহ' পড়ার সময় 'লা' তে এক অালিফ টান দিতে হবে।তেমনই তুমি দেখবে কুরঅান শরীফে তুমি দেখবে কিছু কিছু স্থানে,কিছু কিছু হুরুফে টান দিতে হচ্ছে।এই টান দেওয়াটা ই হলো মাদ করে পড়া।
--কিন্তু অামি বুঝবো কিভাবে কোথায় কোথায় মাদ করতে হবে?
--এটা তো সোজা।মাদের নির্দিষ্ট তিনটি হারফ অাছে।পাশাপাশি এর কিছু নিয়মও অাছে।অপেক্ষা করো অাহলিয়া,ধীরে ধীরে শিখবে।
--অাচ্ছা,তারপর?
--তারপর অার মাত্র তিনটা টপিক,ওয়াকফ,ইবতিদা অার উচ্চারণের পদ্ধতি।ওয়াকফ মানে হলো থেমে যাওয়া।এর নির্দিষ্ট কিছু চিহ্ন অাছে।অার ইবতিদা মানে হলো শুরু করা।ওয়াকফ করার পর পড়া অাবার শুরু করাটা হলো ইবতিদা।বুঝলে?
--হ্যাঁ বুঝলাম।অার উচ্চারণের পদ্ধতি বলতে?মাখরাজ পড়লেই তো বোঝা যাবে হুরুফের উচ্চারণ সম্পর্কে।
--না অাহলিয়া,বোঝা গেলেও সম্পূর্ণ ভাবে বোঝা যাবেনা।
মাখরাজ হলো কোন হারফ কোন স্থান হতে উচ্চারিত হবে সেই স্থান গুলোর পরিচয়।অার উচ্চারণের পদ্ধতি বলতে অামি বুঝিয়েছি উচ্চারণ গুলো কেমন হবে,হালকা না ভারী,মোটা না চিকন,এইগুলো।
--অাচ্ছা,বুঝলাম তারপর?
--তারপর অার কি?অামি তোমাকে তাজউইদ সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা দিলাম।এখন তোমার কাছে দুইটা অপশন অাছে।
১.পাশের এলাকায় একটা মহীলা মাদরাসা অাছে সেখানে গিয়ে তাজউইদ সহ কুরঅান তিলাওয়াত শেখা।
২.বাসায় একজন উস্তাযা রেখে শেখা।
তুমি কোনটা করতে চাও?
--মানে টা কি?অাপনি শেখাবেন না?
--না।
--কেন?
প্রশ্ন শুনে শায়খ একপ্রকার চমকে অামার দিকে তাকালেন।
অাসলে কথাটা থমথমে গলায় বলে ফেলেছি।অবশ্য বলতে গিয়ে কণ্ঠটা একটু ধরেও এসেছিল।মনে একরাশ অভিমান জমা হয়েছে।অাসলে সমস্যা টা কোথায়!এই মানুষটা যদি এভাবেই ভালবেসে অামাকে তাজউইদ শেখায় তাহলে কি এমন হবে?চোখ ঝাপসা হয়ে অাসছে।অামার এই এক স্বভাব।পান থেকে চুন খসলেই কষ্ট লাগে,কান্না অাসে।
সম্ভবত অামার এই অবস্থা দেখেই উনি ব্যস্ত হয়ে উঠে দাঁড়ালেন।অামার সামনে এসে হাঁটুগেড়ে বসে হাতগুলো উনার হাতের মুঠোয় পুরে নিলেন।খুব শান্ত কণ্ঠে বললেন,
--অামিনা!তোমার চোখে পানি কেন?অামি কি তোমায় কষ্ট দিয়েছি?
অামি তো তোমার ভালোর জন্যই উস্তাযা কিংবা মাদরাসায় গিয়ে পড়ার কথা বলছি।অামি চাই অামার অাহলিয়া একদম সহীহ ভাবে কুরঅান শিখুক।পাশাপাশি ছোট ছোট সূরা গুলো অাস্তে অাস্তে মুখস্থ করে ফেলুক।বড় সূরা গুলো নাহয় অামরা একসাথে মুখস্থ করবো।
এখন তুমি বলো তো,মাদরাসায় গিয়ে পড়বে?অবশ্য অামার কাছে ঘরে উস্তাযা রেখে শেখাটাকেই ভালো মনে হচ্ছে।
অামি দীর্ঘশ্বাস ফেলে অন্যদিকে তাকালাম।শায়খের কথায় যুক্তি থাকলেও অামার উনার এই সিদ্ধান্ত পছন্দ হয়নি।উনার কাছ থেকেই তো কত সুন্দর করে শিখতে পারতাম!ভালোই তো লাগে এভাবে শিখতে,তারপরও উস্তাযা কেন......!
--বেলা হয়ে যাচ্ছে।অামি উঠি,অামায় নাস্তা বানাতে হবে।
বলে চলে অাসছিলাম।হটাৎ উনি বলে উঠলেন,
--একটা সুখবর অাছে অাহলিয়া।খোঁজ নিয়েছি অামি।অামাদের এলাকাতেও মহীলাদের তালিম হয়,প্রতিদিন হয়।খোঁজ নিয়ে দেখলাম নির্ভরযোগ্য, তুমি গিয়ে দেখতে পারো।
--কোথায় হয়?কারো বাড়িতে?
--হ্যাঁ,অামাদের এলাকায় যে বড় মাসজিদটা অাছে,ওই মাসজিদের মুয়াজ্জিনের বাসায়।সার্বিক তদারকি উনার স্ত্রী ই করেন।উনার স্ত্রী অার চার মেয়ে।এর মাঝে ছোট মেয়েটা মিশকাতে পড়ছে।বাকি তিনজনই অালিমা অার ওদের মাও অালিমা।তোমার কোনও সমস্যা হবে না ইনশাআল্লাহ।
উনার এই কথা শুনে সব অভিমান কোথায় যেন মিলিয়ে গেলো।মন চাচ্ছিলো এখনই দৌঁড়ে শ্বাশুড়ি মাকে নিয়ে তালীমে যেতে।কখনও যাওয়ার সৌভাগ্য হয়নি।না জানি কত সুন্দর হবে তালীমে যাওয়ার অভিজ্ঞতা টা।অামি চোখ বুজে খানিকটা শব্দ করে অালহামদুলিল্লাহ বলে উঠলাম।
--কি গো অাহলিয়া?অামি এত কষ্ট করে খোঁজ নিলাম।অার অামার অাহলিয়া অামায় ধন্যবাদটুকুও দিলো না!
কপট অভিমানের সাথে বললেন শায়খ।অামি লজ্জায় চোখ নিচু করে ফেললাম।অাসলেই তো উনাকে ধন্যবাদ দেওয়া উচিৎ। অাস্তে করে বললাম,
--ঠিক অাছে,খোঁজ নেওয়ার জন্য ধন্যবাদ।
--উঁহু,ধন্যবাদ নয়।বলো "জাযাকাল্লাহু খয়রন"।এটা সুন্নাহ তো।
--এই বাক্যটা অনেক জায়গায় দেখেছি অামি।এটার মানে কি?
--এটার মানে হলো,"অাল্লাহ অাপনাকে উত্তম প্রতিদান দিন।"
অার কেউ যদি তোমাকে জাযাকাল্লাহু খয়রন বলে, তাহলে তুমি তাকে উত্তর দিবে,'ফা জাযাকুমুল্লাহু খয়রন' বলে,কেমন? অবশ্য 'ওয়া অান্তুম ফা জাযাকাল্লাহু খয়রন,ওয়া ইয়্যাক' ও বলা যায়।
এর অর্থ হবে,"আল্লাহ আপনাকেও উত্তম প্রতিদান দিন"।বুঝলে?
--হ্যাঁ,বুঝলাম।এবার রান্নাঘরে যাই কেমন?অাসসালামু অালাইকুম।
ইনশাআল্লাহ চলবে.......

2 comments

আলহামদুলিল্লাহ

আলহামদুলিল্লাহ আলহামদুলিল্লাহ আলহামদুলিল্লাহ। আমার জীবনে পড়া সবচেয়ে শিক্ষনীয় গল্পের মধ্যে এটা একটা। আল্লাহ যেন গল্পের লেখক ও পাঠক সবাই কে জান্নাত বাশি করেন।। ইনসাআল্লাহ আমরা সবাই এ ধরনের শিক্ষনীয় গল্প লিখে দিন প্রচার করব।।


EmoticonEmoticon