Nov 7, 2018

স্বামী ও স্ত্রীর ভালোবাসার গল্প পর্ব - ৫



পর্ব পাঁচ........
সারাটা রাত অামার কতটা অস্বস্তিতে কাটছিল,বোঝানো সম্ভব নয়।মাথায় হাজারো চিন্তা জট পাকিয়ে যাচ্ছিল।শেষে অার সহ্য করতে না পেরে উঠে সাজদায় পরে গেলাম।যত অভিযোগ,সন্দেহ ছিল,সব রব্বকে জানিয়ে উপায় খুঁজছিলাম।স্বলাত শেষে সূরা ইনশিরাহ পড়লাম অনেকক্ষণ ধরে।স্বস্তি না মিললেও বুক থেকে ভারী বোঝা নেমে গেছে,এটা অন্তত বুঝেছি।পানি খাওয়ার জন্য টেবিলের কাছে অাসতেই দেখি শায়খের ফোন!ধরবোনা ধরবোনা করেও ফোনটা হাতের মুঠোয় পুরে নিলাম।কোনও পাসওয়ার্ড,পিন,লক না থাকায় ফোনলক খুলতে অামায় বেগ পেতে হয়নি।গ্যালারি,ইনবক্স,কললিষ্ট,ফেসবুক,ম্যাসেঞ্জার,ইমো,হোয়াটসঅাপ...........
কোনও কিছুই চেক করা বাকি রাখিনি। কিচ্ছু নেই!বিশ্বাস করুন,একদম কিচ্ছু নেই।উনাকে সন্দেহ করার মতন একদমই কিচ্ছু পাইনি ফোনে।হতাশ হয়ে ফোনটা রেখে দেওয়া মাত্রই অাবার বিদ্যুৎ গতিতে ফোনটা হাতে নিলাম।সব চেক করেছি,কিন্তু কন্টাক্ট লিস্ট তো চেক করিনি!! কাঁপা কাঁপা হাতে কন্টাক্ট লিস্টে ক্লিক করলাম।সবগুলো সেভ করা নাম্বার দেখছিলাম।হটাৎ চোখ অাটকে গেলো,একটা নাম্বারে......
'দুহার অাম্মু' দিয়ে সেভ করা নাম্বার টা।দুহা কে অামি জানিনা।দুহার অাম্মু কে তাও জানিনা।কিন্তু এখনই যদি জানতে না পারি,তাহলে এই সন্দেহটা অামায় কুঁড়ে কুঁড়ে খাবে।রুম থেকে বেরিয়ে এসে ওই নাম্বারে ডায়াল করলাম।একবার...দুইবার...তিনবার......
বেশ কয়েকবার ডায়াল করার পর,অনেকটা ঘুমে জড়ানো কিন্তু উত্তেজিত নারী কণ্ঠ ওপাশ থেকে কোনও সূচনা ছাড়াই বলে উঠলো.......
'বাহ!বাহ!মোল্লা সাহেবের তাহলে মনে পড়েছে অামাকে.....
অামি জানতাম,যতই মোল্লাগিরি দেখাও,তুমি অামায় ছাড়া অন্য কাউকে স্ত্রী হিসেবে মেনে নিতে পারবেনা।তো মোল্লাসাহেবের কি খবর?কালকের রাতটা কেমন কাটলো?'
একেকটা কথা অামায় তীরের মতন বিদ্ধ করছিল।কিছু বলার বা শোনার সাহস হয়নি অামার অার।লাইনটা কেটে দিয়ে ফোনটা অাবার অাগের জায়গায় রেখে দিলাম।কোনওমতে টলতে টলতে জায়নামাজে ফিরে এসেছি অামি।বিয়ের দ্বিতীয় দিনেই যদি কোনও মেয়েকে জানতে হয়,তার স্বামীর প্রতি অন্য একটা মেয়ের এমন উক্তি,তাহলে ওই মেয়েটার হালত কেমন হওয়া উচিত!!
অামার দুচোখ বেয়ে অঝোর ধারায় অশ্রু ঝরছিল।দাঁতে দাঁত চেপে কান্না চাপার অপ্রতিরোধ্য চেষ্টা করা সত্ত্বেও ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিলাম।অামার গোঙানিতে,নাকি উনার অভ্যাসবশত বলতে পারিনা,হটাৎই উনার ঘুম ভেঙে গেল।খুব শব্দ করে পড়ে উঠলেন,
"অালহামদুলিল্লা হিল্লাযি অাহ ইয়ানা বা'দামা অামাতানা,ওয়া ইলাইহিন নুশুর"
বিছানা থেকে উঠে অামার কাছে এসে,সালাম দিয়ে কয়েকবার কান্নার কারণ জানতে চাইলেন।অামার অবস্থা এমন ছিলো যে,তাকে দেখামাত্র কান্নার বেগ অারও বেড়ে যাচ্ছিল।তিনি অামাকে যতবার স্পর্শ করছিলেন,অামি ততবার তাকে সরিয়ে দিচ্ছিলাম।অাসলে অামার তার প্রতি এই দুইদিনে যত শ্রদ্ধা জেগেছিল,সব এখন ঘেন্না অার বিদ্রুপে পরিণত হয়ে গেছে।তাকেও অন্য পাঁচজন লেবাসধারী মুসলিমের মতনই মনে হচ্ছে,যারা মুমিন হওয়ার নাটক করে।রাগে,ঘেন্নায় উনার পাশ থেকে উঠে পরি।উযু করে এসে অাবারও স্বলাতে দাঁড়াই,সাজদায় গিয়ে অামি অাগে কখনও বাংলায় দুঅা করিনি,কিন্তু সেদিন করেছিলাম।খুব করে অাল্লাহকে বলেছিলাম অামার দুঃখের ভার কমিয়ে দিতে,অামায় পথ দেখাতে।
সাজদাহ থেকে যখন উঠেছিলাম,অামার মনে হচ্ছিল,সব কষ্ট শেষ।কান্না অাটকে রাখলে গলায় যে চাপা ব্যাথাটা হয়,সেটা অার নেই,অশ্রুও অার গড়াচ্ছে না,একদম হালকা লাগছে নিজেকে।সালাম ফিরিয়ে অামি পরিপূর্ণ দৃষ্টিতে উনার দিকে তাকালাম।উনি অামার জায়নামাজের পাশেই বসে ছিলেন।অামাকে উনার দিকে তাকাতে দেখে অাবারও এগিয়ে এলেন।বলা শুরু করলেন,
--তোমার অাসলে কি হয়েছে বলো তো?এমনভাবে কাঁদছো কেন তুমি?তুমি কাঁদলে অামার খারাপ লাগে।কি হয়েছে বলো?বাবা মায়ের কথা মনে পড়ছে?অামি কোনওভাবে তোমায় কষ্ট দিয়েছি?অামার পরিবার তোমাকে অাপন করে নিচ্ছেনা বলে কষ্ট পাচ্ছ?ও অামিনা!চুপ কেন তুমি? কিছু তো বলো!প্লিজ......
কিছু একটা বলো!
অামি স্থির কণ্ঠে বললাম,
"দুহার অাম্মু ই কি নাবিলা?"
এক ঝটকায় বসা থেকে উঠে দাঁড়ালেন তিনি। অামায় স্পর্শ করতে গিয়েও করেন নি অার।বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে ছিলেন।উনার এই কিংকর্তব্য বিমূঢ় অবস্থা দেখে অামি অাবারও প্রশ্ন করলাম....
--অাহলিয়া হিসেবে কি অামি অাপনার কাছ থেকে এই প্রশ্নের উত্তর জানতে পারিনা?অাপনি অামার অলঙ্কার,ঠিক একই ভাবে অামিও তো অাপনার অলঙ্কার।তাহলে অাপনার অামার মাঝে রাখঢাক কেন থাকবে?কি লুকাচ্ছেন অাপনি অামার থেকে?
প্রশ্ন গুলো করার সাথে সাথেই তিনি ডুকরে কেঁদে উঠলেন।অামার কাছে খুব কাকুতিভরা কণ্ঠে জানতে চাইলেন,
--এসব না জানলে কি হয়না অামিনা?
--সবটুকু না জানলে অামি স্বস্তি পাচ্ছিনা জনাব।
নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে উত্তর দিলাম।
--অামিনা!ও অামিনা!তুমি কি জানো না,পাপ প্রকাশ করা গুনাহ?অামি এমনিতেই অনেক গুনাহগার,পাপ প্রকাশ করতে বাধ্য করে অামার গুনাহ অার নাইবা বাড়ালে.....
--অামি কিচ্ছু জানিনা,জানতে চাইওনা।অামি শুধু নাবিলা অার দুহার অাম্মুর ব্যাপারে জানতে চাচ্ছি।
তিনি কিছুটা শান্ত হয়ে অামার কাছ থেকে জানতে চাইলেন অামি দুহার অাম্মু,অার নাবিলার কথা কার কাছ থেকে জানতে পেরেছি।
অামি নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে জায়গা থেকে উঠে টেবিলের উপর থেকে তাকে তার ফোনটা এনে দিলাম।হাঁটার সময় খেয়াল করলাম অামি এখন অার টলছি না।কষ্টের অনুভূতি ও কমে গেছে।এতক্ষণ যে উত্তাল সমুদ্র বহমান ছিল অামার মাঝে,তা এখন একেবারেই শান্ত হয়ে গেছে।অামি ফোন এনে উনার হাতে দিতেই দেখতে পেলাম,প্রায় ত্রিশটি মিসড কল,সবগুলোই দুহার অাম্মু দিয়েছে।এটুকু দেখেই তিনি একপ্রকার অার্তনাদ করে বললেন,
--এ কি করেছ অামিনা!এ কি করলে তুমি!!তুমি কি জানোনা, কারও দোষ ত্রুটি অনুসন্ধান নিয়ে কতবার নিষেধাজ্ঞা এসেছে?তুমি জানোনা,সূরা হুজুরাতে স্পষ্ট বলা হয়েছে,কারও গোপন বিষয় অনুসন্ধান না করতে?তবুও তুমি এটা কেন করলে?
--অামি জানিনা এত কিছু।অাপনি অাগে অামার প্রশ্নের উত্তর দিন।
--তুমি কি জানোনা,বিয়ের অাগে কৃত গুনাহ, বিয়ের পর প্রকাশ করা উচিৎ নয়।অামিনা!কেন জেদ করছো?যা কিছু কল্যানকর নয়,তা তুমি নাইবা জানলে....
--অামি না জানলে শান্তি পাবনা জনাব।সন্দেহ খুব খারাপ,খুবই ভয়ানক!
--বেশ!তাহলে শুনো,নাবিলা ছিল অামার ব্যভিচারের সঙ্গী।অাঠার বছর বয়স থেকে একুশ বছর বয়স পর্যন্ত অামি শায়ত্বানের ধোঁকায় তার সাথে ব্যভিচারে মগ্ন ছিলাম।যিনাহয় মগ্ন ছিলাম।
অামিনা!যখন অামি হিদায়াত পেলাম,বুঝতে পারলাম,এটা কত বড় গুনাহ,অামি বারবার তাকে বিয়ে করতে চেয়েছি।অামি জানিনা কেন,কোন কারণে সে অার অামায় বিয়ে করতে রাজি ছিলনা।তবে অামি চেয়েছিলাম তাকে বিয়ে করতে,পাপ হতে মুক্তি পেতে।
--যিনাহয় মত্ত ছিলেন মানে!অাপনাদের কি শারীরিক......
--না অামিনা,না!
অামার মুখের কথা টেনে নিয়েই বললেন তিনি।
তুমি জানোনা অামিনা,অামি তার কাছে অক্ষম একটা মানুষ।তার হাত ধরা ব্যতিত তার অার কাছে যাইনি বলে সে অামায় প্রচুর অবজ্ঞা করতো,নপুংসক বলতেও দ্বীধা করতো না।কিন্তু অামি অামার চিন্তায় অটল থাকতাম।যিনাহয় মত্ত থাকার মানে কেবলমাত্র শারীরিক বোঝাপড়া হয়ে যাওয়া,তা তোমায় কে বললো?তুমি কি চোখের যিনাহ,হাতের যিনাহ,পায়ের যিনাহ,জিহ্বার যিনাহ সম্পর্কে ভুলে যাচ্ছ?যেখানে অাকৃষ্ট হওয়ার অাশংকা থাকলে ওযর ছাড়া গায়রে মাহরামের সাথে কথা বলা ই জায়েজ না,সেখানে একজনের সাথে অামি 'প্রেম' নামক হারাম সম্পর্কে মগ্ন!এটা কি যিনাহ নয় অামিনা?লজ্জাস্থান তো কেবলমাত্র যিনাহকে পরিপূর্ণতা দেয় অামিনা!!হারাম কিছুতে দৃষ্টিপাত,কথাবার্তা,কাজকর্ম সবই হারাম।
--অাপনি এত ধার্মিক হয়েও এসবে জড়ালেন কিভাবে!?!
--বিশ্বাস করো অামিনা,অামি তখন নামমাত্র মুসলিম ছিলাম।অামার পরিবারের দিকে তাকালেই তুমি বুঝতে পারবে।অামি শুধু জানতাম,বিয়ের অাগের প্রেমে অশ্লীলতা না থাকলে তা জায়েজ।অামি জানতাম কেবলমাত্র ফিজিক্যাল রিলেশনশীপই যিনাহ।বাদবাকি হাত ধরা,চুমু,কিংবা জড়িয়ে ধরা যা কিছুই হোক না কেন,তা জায়েজ।অামি জানতাম,কথা বার্তা হয়না,দেখা হয়না,তবুও দূর থেকে ভালবাসলে তা জায়েজ।এটাও যে মনের যিনাহ,তা অামি জানতাম না অাহলিয়া......
--অার দুহার অাম্মু?সে কে?
--অামার স্বপ্ন ছিলো অামাদের মেয়ের নাম দুহা হবে।সেইজন্যই নাবিলার নাম দুহার অাম্মু দিয়ে সেভ করেছিলাম।
--বুঝলাম।
--অামিনা!বিশ্বাস করো অামিনা!
অামি জানতাম না যিনাহর শাস্তি এত ভয়াবহ যে,অবিবাহিত যুবক যুবতী ব্যভিচারে লিপ্ত হলে তার ইহকালীন শাস্তি হিসেবে দুজনকেই ১০০ বেত্রাঘাত করতে হবে এবং সাথে একবছরের জন্য বহিষ্কার হতে পারে সমাজ হতে।অামি জানতাম না,ব্যভিচারীদের সাথে অাল্লাহ কিয়ামতের দিন কথা বলবেন না,অামি জানতাম না,ব্যভিচারীরা উলংগ অবস্থায় এমন এক চুলার মধ্যে থাকবে যার অগ্রভাগ হবে অত্যন্ত সংকীর্ণ আর নিম্নভাগ হবে প্রশস্ত উহার তলদেশে অগ্নি প্রজ্বলিত থাকবে তাদেরকে তাতে দগ্ধ করা হবে। তারা মাঝে মধ্যে সেখান থেকে বের হয়ে যাওয়ার কাছাকাছি অবস্থায় পৌছে যাবে; অত:পর আগুন যখন স্তমিত হয়ে যাবে তখন তাতে তারা আবার ফিরে যাবে। আর তাদের সাথে এই আচারণ কেয়ামত পর্যন্ত করা হবে.........
অামি খুবই লজ্জিত অামার এই পাপের জন্য,অামি সবসময় অাল্লাহর কাছ থেকে এই গুনাহ থেকে মাফ চাই অামিনা.....
এখনও চাই।অামিনা,এটা তো তোমার হক্ব ছিলো,যা যিনাহর দ্বারা অামি নষ্ট করেছি।এই অামিনা!তুমি অামায় মাফ করবে তো?অামিনা!!চুপ করে থেকো না।অন্তত একটা অাশার বাণী শোনাও।
মানুষটা কাঁদছেন।উনার চাপা কান্না অামার হৃদয়ে অন্তঃদহন ঘটাচ্ছে।অামি ধীরে ধীরে তার কাঁধে হাত রেখে বললাম,
--চলুন,তাহাজ্জুদের সময় শেষ হয়ে অাসছে।তাহাজ্জুদ পড়বেন চলুন।
--অামার উপর এখনও রাগ করে অাছ তুমি?অামায় মাফ করবে না?
--তাওবাহ করলে তো স্বয়ং অাল্লাহই মাফ করবেন।অামার রব্ব যখন তাওবাকারীকে মাফ করে দেন,তখন তার বান্দা হয়ে তাওবাকারীর উপর ক্ষোভ রাখার মতন এতটাও দুঃসাহস অামার নেই শায়খ!!
প্রথমবারের মতন তাকে অামি শায়খ বলে ডাকলাম।অামার ডাক শুনে,নাকি অামার উত্তর শুনে জানিনা,উনি অামায় বুকে জড়িয়ে নিয়েছিলেন।
কাঁদছেন উনি,কাঁদছি অামিও.........
কিসের কান্না কে জানে...............
হটাৎ ফিসফিসিয়ে উনি অামায় বলে উঠলেন,
--সো মাই ডিয়ার অাহলিয়া,ডু ইউ নিড মোর টাইম?
--নো ডিয়ার,নিদার টাইম,নর স্পেস............
লজ্জা মিশ্রিত কণ্ঠে উত্তর দিলাম।মাত্র দুদিনের সম্পর্কে এতটা সহজ হয়ে কিভাবে তার সাথে কথা বলছিলাম কে জানে।খুব প্রশান্তি লাগছিলো।মুখ ফুটে অজান্তেই বের হয়ে এলো,
অালহামদুলিল্লাহ..............!!
ইনশাআল্লাহ চলবে.........


EmoticonEmoticon